তথ্য গোপন করে আইপিওতে মিডল্যান্ড ব্যাংক

৫শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে কানাডায় ব্যাংকের পরিচালক বাদশা

0

স্টকরিপোর্ট ডেস্ক : সিআইবি রিপোর্টে ইসা বাদশার ঋণ খেলাপির কোনো তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের নামে ৫শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে মালিক পালিয়েছেন কানাডা। পলাতক ঋণ খেলাপি ঈসা বাদশার প্রতিষ্ঠান মিডল্যান্ড ব্যাংক ৭ কোটি প্রাইমারি গণপ্রস্তাব (আইপিও) ছেড়ে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ৭০ কোটি টাকা। সূত্র ইনকিলাব।

প্রতিষ্ঠানটির ইস্যু ম্যানেজার লঙ্কাবাংলা ইনভেস্টমেন্টস লিমিটেড। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) থেকে শুরু হয়েছে আবেদন গ্রহণ। চলবে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। অভিযোগ উঠেছে, মিডল্যান্ড ব্যাংক পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)র, দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা, ইস্যু ম্যানেজার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণ খেলাপির তথ্য গোপন করে অনুমোদন দিয়েছেন আইপিওর।

সাধারণ বিনিয়োগকারীদের পকেট কাটতে মিথ্যা তথ্য ও জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে আইপিও অনুমোদন করে বিএসইসি। সংস্থাটির ৮৩৯ তম কমিশন সভায় আইপিও অনুমোদন দেয়া হয়। অনুমোদন গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের পেছনে মিডল্যান্ড ব্যাংক খরচ করেছে প্রায় ৪ কোটি টাকা।

তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, মিডল্যান্ড ব্যাংকের গণপ্রস্তাবে স্পন্সর শেয়ার হোল্ডার হিসেবে ৩৩ নম্বরে রয়েছে আলহাজ মোহাম্মদ ইসা বাদশার নাম। তিনি বাদশা শিল্প গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। শিপ ব্রেকিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে মোহাম্মদ ইসা বাদশা ৮টি ব্যাংক থেকে ৫শ’ কোটি টাকা ঋণ নেন। এই ঋণের অর্থ শিল্পোন্নয়নে ব্যয় না করে পাচার করেন কানাডায়। সেখানে কিনেছেন বিলাসবহুল বাড়ি।

টরেন্টোর লেকশোর এলাকায় কিনেছেন ফ্ল্যাট, গড়েছেন নামে-বেনামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেসব ব্যাংক থেকে বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ৫শ’ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন সেসব ব্যাংকও এখন ঋণের টাকা আদায় করতে পারছে না। এ সংক্রান্ত দায়েরকৃত একাধিক মামলায় তিনি এখন পলাতক।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী আলহাজ মো. বাদশা মিয়া জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প বা স্ক্র্যাপ কেনা-বেচা দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাদশা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’। ট্রেডিং অ্যান্ড কমিশন এজেন্ট মুসা-ইসা ব্রাদার্স, স্ক্র্যাপ ট্রেড ও শিপ ব্রেকার্স প্রতিষ্ঠান মেসার্স ঝুমা এন্টারপ্রাইজ, ট্রেডিং অ্যান্ড কমিশন এজেন্ট এমএম এন্টারপ্রাইজ, সাবান ও তেল কোম্পানি বাদশা ওয়েল অ্যান্ড সোপ ফ্যাক্টরি ও ডেইরি অ্যান্ড ডেইরি ফুড প্রোডাক্ট প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবিত ‘আজান এন্টারপ্রাইজ’।

এছাড়া খাতুনগঞ্জের বাণিজ্যিক ভবন বাদশা মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যবসা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান কার্যালয় বাদশা মার্কেট ১৭৩, খাতুনগঞ্জ, চট্টগ্রাম। বাদশা মিয়ার বড় ছেলে ইসা বাদশা মিডল্যান্ড ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালক। ৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে তার।

ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখা থেকে ইসা বাদশার প্রতিষ্ঠান এমএম এন্টারপ্রাইজ ও ঝুমা এন্টারপ্রাইজ নামে দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে নিয়েছেন বিপুল অংকের ঋণ। এটির কাছ থেকে ব্যাংকটির এখন পাওয়া ১৫৬ কোটি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। ওয়ান ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখা মুসা অ্যান্ড ইসা ব্রাদার্সের কাছ থেকে পান ১৬৮ কোটি টাকা। ঝুমা এন্টারপ্রাইজের নামে ইসা বাদশা শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছেন ৫৬ কোটি টাকা। এক্সিমব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা পাবে ১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা। ইসা বাদশার কাছ থেকে মার্কেন্টাইল খাতুনগঞ্জ শাখা পাওনা ৭৫ কোটি টাকা। মেঘনা ব্যাংক জুবিলী রোড শাখা পাবে ৬০ কোটি টাকা। ঝুমা এন্টারপ্রাইজের নামে নেয়া ঋণের ৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা পাবে প্রাইম ব্যাংক। আল আরাফা ইসলামী ব্যাংকও ইসা বাদশার কাছে বিশাল অঙ্কের ঋণের টাকা পাওনা।

ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা ২০১৯ সালে ইসা-মুসা ব্রাদার্সের বন্ধকী সম্পত্তি নিলামে তোলে। পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইস্টার্ন ব্যাংক চট্টগ্রামের ঋণ গ্রহিতা মেসার্স এমএম ইন্টারপাইজ ও মেসার্স ঝুমা এন্টারপ্রাইজ। উভয় প্রতিষ্ঠানের মালিক আলহাজ মোহাম্মদ ইসা বাদশা ওরফে মহসিন ও মোহাম্মদ মুসা বাদশা।

এমএম এন্টারপ্রাইজের কাছে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ঋণের বিপরীতে সুদসহ ৩৩ কোটি ৫১ লাখ ১৭ হাজার টাকা এবং ঝুমা এন্টারপ্রাইজের ঋণের বিপরীতে সুদসহ ১২২ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৯৭৬ টাকা পাওনা। অর্থাৎ দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে সুদসহ ব্যাংকটির পাওনা ১৫৬ কোটি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার ৬৩ টাকা। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দলিল ও জমির নম্বর উল্লেখসহ দশ শর্তে বন্ধকী সম্পত্তি নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, দেশের ৮টি ব্যাংক ইসা বাদশা পরিবারের কাছ থেকে অন্তত ৫শ’ কোটি টাকা পাওনা। ঋণ নিয়ে তারা এদেশের কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করেনি। সমুদয় অর্থ অবৈধ পন্থায় পাচার করেন কানাডায়। ঋণের টাকায় সেখানে তারা বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছেন।

ঋণের কাগজপত্রে ইসা-মুসার আবাসিক ঠিকানা চট্টগ্রামের খুলশী থানার ৫ নম্বর সড়কের ১৩, খুলশী হিল। সীতাকু-ের মধ্য সোনাইছড়িতে তাদের জমিসহ বিভিন্ন সম্পত্তি রয়েছে। নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশেও তারা ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে অর্থ পাচার করেন বলে জানা যায়।

যে ব্যাংকের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক ঋণ খেলাপি এমন প্রতিষ্ঠান কি করে আইপিও অনুমোদন পেলো? এ প্রশ্ন করা হয়েছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন। জবাবে সংস্থাটির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, পরিচালকদের কেউ ঋণ খেলাপি কি না, সেটি প্রত্যয়ন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সিআইবি রিপোর্টে ইসা বাদশার ঋণ খেলাপির কোনো তথ্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক নিশ্চয়ই বিধিবিধান মেনে প্রতিবেদন দেয়। সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন প্রাপ্ত রেকর্ডপত্রের ভিত্তিতে নিশ্চিয়ই বিধি মোতাবেক আইপিও অনুমোদন করেছে।

যে প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা পরিচালকই ঋণ খেলাপি এবং পলাতক সেই প্রতিষ্ঠান কোনো মানদণ্ডে আইপিও অনুমোদনের আবেদন করেছে, জানতে চাওয়া হয় মিডল্যান্ড ব্যাংকের কাছে। জবাবে প্রতিষ্ঠানটির কোম্পানি সেক্রেটারি মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ইসা বাদশার ঋণ খেলাপির বিষয়টি আমরা অবহিত। সেটি জেনেই বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান ১৭ (৫ ) ধারা অনুসারে বিএসইসি আইপিও অনুমোদন করেছে। ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী ইসা বাদশার শেয়ারগুলো এটাচড হয়ে যাবে। সেই অনুযায়ী আমরা বাংলাদেশ থেকে চিঠিও পেয়েছি। যদিও কি উপায়ে শেয়ার লিকুইডেট হবে সেটি বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধানে উল্লেখ নেই।

কোম্পানি সচিব আরও বলেন, ইসা বাদশা ৪ বছর হলো আমাদের বোর্ডে নেই। তিনি স্পন্সর শেয়ার হোল্ডারমাত্র। কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় তার কোনো ভূমিকা নেই। এসব তথ্যের ডিসক্লোজার আইপিও প্রসপেক্টাসে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো বিধানের ব্যত্যয় ঘটেনি।

তবে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি)’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. হামিদউল্লাহ ভুঁইয়া বলেন, আইনে স্পষ্টতই বলা আছে, কোনো প্রতিষ্ঠানে ঋণ খেলাপি থাকলে প্রতিষ্ঠানের আইপিও অনুমোদন পেতে পারে না। এখানে গোজামিলের কোনো সুযোগ নেই। কোন বিবেচনায় উক্ত প্রতিষ্ঠান আইপিও অনুমোদন পেলো বোধগম্য নয়।

Leave A Reply

Your email address will not be published.