পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি বাড়িয়েছেন বিদেশিরা

0

স্টকরিপোর্ট ডেস্ক : ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান হ্রাস এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের পুঁজিবাজারে শেয়ার বিক্রি বাড়িয়ে দিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। অর্থাৎ বিদেশিদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের পরিমাণ আগের তুলনায় বেড়েছে।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য মতে, গত আগস্ট মাসে বিদেশিদের পোর্টফোলিও অ্যাকাউন্টে যেখানে ৮৬ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়েছে, সেখানে বিক্রি হয়েছে ৬৬৮ কোটি টাকার শেয়ার। অর্থাৎ গত এক মাসেই বিদেশিরা নিট ৫৮২ কোটি টাকার শেয়ার বেশি বিক্রি করেছেন। জুলাই মাসে নিট বিক্রি ছিল ১৩৯ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য ভালো ফান্ডামেন্টাল কোম্পানিগুলোর শেয়ারকেই বেছে নেয়। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান হ্রাস এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থা বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের বড় কারণ। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ কারণে ভারতসহ এশিয়ার প্রায় সব দেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হচ্ছে। গত এক মাসে দেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১১ হাজার।

তবে কমেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসের শেষ কার্যদিবস বা ৩১শে জুলাই বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব ছিল ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৮৮৪টি, যা বেড়ে এখন (৫ই সেপ্টেম্বর) দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ৪৪ হাজার ৫৮টিতে। অর্থাৎ গেল এক মাসে ১০ হাজার ১৭৪টি বিও হিসাব বেড়েছে। তবে কমেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীর সংখ্যা। বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নামে বিও হিসাব রয়েছে ৬৩ হাজার ৪২৩টি।

জুলাই শেষে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ৬৪ হাজার ২৬১টিতে। অর্থাৎ এক মাসে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ৮৩৮টি। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ক্রমাগত বিনিয়োগ প্রত্যাহার করছেন। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুধু সাম্প্রতিককালে বিদেশিরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছেন বিষয়টি এমন নয়, গত কয়েক বছর থেকেই তাদের বিনিয়োগ ধীরে ধীরে কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ৮ মাসে প্রবাসীসহ বিদেশিরা সর্বমোট ৩ হাজার ২০৯ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা করেছেন। এর মধ্যে ৭৯৫ কোটি টাকার শেয়ার কেনেন। বিপরীতে বিক্রি করেন ২ হাজার ৪১৪ কোটি টাকার শেয়ার। কেনার তুলনায় বিক্রি বেশি ১ হাজার ৬১৮ কোটি টাকার শেয়ার।

২০২১ সালে বিদেশিদের পোর্টফোলিও থেকে নিট ৪ হাজার ৯৫০ কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি হয়। এর মধ্যে কেনা হয় ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকার শেয়ার। সর্বশেষ ২০ মাসের মধ্যে শুধু গত বছরের ডিসেম্বরে বিক্রির তুলনায় শেয়ার কেনার পরিমাণ বেশি ছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশি ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে ১৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ডলারের গড়মূল্য ৮৮ টাকা দরে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে যা ছিল ২৬ কোটি ৯০ ডলার বা প্রায় ২৩০০ কোটি টাকা। তবে বিদেশিরা যখন শেয়ার বিক্রি করে টাকা নিয়ে যাচ্ছেন, তখন প্রবাসীদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসীরা নিট ১১ কোটি ৪০ লাখ ডলার বা ১ হাজার কোটি টাকা নিট বিনিয়োগ করেছেন।

আগের ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ২০ কোটি ৯০ লাখ ডলার বা পৌনে ১৮০০ কোটি টাকা। প্রবাসীদের নিট বিনিয়োগের তথ্য যোগ করেই বিদেশি বিনিয়োগের হিসাব করা হয়। এর অর্থ বিদেশিদের নিট বিনিয়োগ প্রত্যাহারের অঙ্ক ২৭ কোটি ডলারের বেশি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্সের তথ্যমতে, ডিএসইতে বিদেশি বিনিয়োগ অবস্থান করছে গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে। সাত বছরের মধ্যে ডিএসইতে বিদেশি বিনিয়োগ বাজার মূলধনের সর্বোচ্চ ৬.৮ শতাংশ থেকে কমে সর্বনিম্ন ৩.৯ শতাংশে অবস্থান করছে। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, চলতি বছরের জুনের শেষে ডিএসইতে বিদেশি যে পরিমাণ বিনিয়োগ এসে নেমেছে, তা ২০১৫ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন। ২০১৯ সালে বাজার মূলধন হিসাবে বিদেশি বিনিয়োগ সর্বোচ্চ ছিল।

বিদেশি বিনিয়োগে শীর্ষে ১০ কোম্পানি: দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ১০ কোম্পানিতে বিদেশিদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ রয়েছে। এই দশ কোম্পানির শেয়ারে গত জুন-২০২২ সাল পর্যন্ত অন্যান্য কোম্পানি থেকে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদেশি মালিকানাসহ সমস্ত কোম্পানির মধ্যে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের সর্বোচ্চ ৩৬.১ শতাংশ বিদেশি শেয়ার ছিল, এর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বেক্সিমকো ফার্মার ২৮.৬ শতাংশ।

তৃতীয় অবস্থানে থাকা অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ’র বিদেশি মালিকানায় রয়েছে ২৫.৭ শতাংশ, রেনাটা লিমিটেড’র ২২.৯ শতাংশ, ইসলামী ব্যাংক’র ২০.৬ শতাংশ, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং ফাইন্যান্স করপোরেশন’র (ডিবিএইচ) ১৯.৩ শতাংশ, বিএসআরএম লিমিটেড’র ১৭.৫ শতাংশ, স্কয়ার ফার্মা’র ১৩.৯ শতাংশ, রিং শাইন টেক্সটাইল’র ১০.২ শতাংশ এবং শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ’র ৯.৪ শতাংশ। শেয়ারবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বেশির ভাগ কোম্পানিতেই সুশাসনের অভাব। কোম্পানিগুলোর পর্ষদ মিথ্যা আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে। যে কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আস্থা হারাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে হলে এবং তাদের ধরে রাখতে হলে শেয়ারবাজারে ভালো কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। এ ছাড়া টাকার মান হ্রাস ও অর্থনৈতিক অস্থিশীলতার কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছে। তবে আমি মনে করি সার্বিকভাবে বর্তমানে শেয়ারবাজার বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত। তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকতে হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.