লোকসানি আইসিবিতে শতকোটি টাকার তহবিল দিচ্ছে বিএসইসি!

0

স্টকরিপোর্ট ডেস্ক : আন্তর্জাতিক হিসাব মান অনুযায়ী, লোকসানি শেয়ারে বিনিয়োগের বিপরীতে নির্দিষ্ট হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এ হিসাব পদ্ধতি মানলে বর্তমানে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) লোকসানে রয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রভিশনও সংরক্ষণ করতে পারেনি। প্রভিশন ঘাটতি রেখেই ডিভিডেন্ড দিয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানেই নতুন করে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে তহবিল জোগান দিতে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। খবর শেয়ারবিজ ডটনেট।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, জনগণের অর্থ দিয়ে অতিমূল্যায়িত শেয়ারে বিনিয়োগ করা হবে। বর্তমানে যাদের কাছে এসব শেয়ার রয়েছে; নতুন করে আরও বেশি দরে শেয়ারগুলো কিনে নেয়া হবে। এক কথায় বলতে গেলে, শেয়ারের ডাম্পিং বা পার্কিং স্পট হবে আইসিবি। পরবর্তীকালে এসব শেয়ার সহজে বিক্রি করতে পারবে না আইসিবি। আর্থিক প্রতিবেদনে দীর্ঘদিন আন-রিয়েলাইজড লস হিসেবে দেখানো হবে।

এ বিষয়ে আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল হোসেন বলেন, ‘আইসিবি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থের পাশাপাশি পুঁজিবাজার ও শেয়ারহোল্ডার বিষয়েও খেয়াল রাখে। এজন্য অভিজ্ঞ বিনিয়োগ টিম রয়েছে। মার্কেট স্টাবিলাইজেশনের যে ফান্ড নেয়া হচ্ছে তাও বিনিয়োগ করা হবে কোম্পানির ফিউচার (ভবিষ্যৎ) দেখেই।’

অতিমূল্যায়িত শেয়ারে বিনিয়োগ করা হবে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যদি কোম্পানির সম্ভাবনা দেখা দেয়, আমাদের কাছে কোনো তথ্য থাকে, ভবিষ্যতে শেয়ারে লাভ হতে পারে; এমন বিষয়টি বিনিয়োগ টিম বুঝতে পারলে সেখানে বিনিয়োগ করা হবে।’ কোনো শেয়ার অতিমূল্যায়িত হিসেবে চিহ্নিত করার নিজস্ব কোনো নীতি আছে কি না? এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি তিনি।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অবণ্টিত বা অদাবিকৃত পড়ে থাকা লভ্যাংশ দিয়ে বাজার উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে বিএসইসি। এজন্য ‘ক্যাপিটাল মার্কেট স্টাবিলাইজেশন ফান্ড’ নামে একটি তহবিল গঠন করা হয়। এটি পরিচালনা করতে ‘ক্যাপিটাল মার্কেট স্টাবিলাইজেশন ফান্ড রুলস-২০২১’ তৈরি করা হয়। সিডিবিএল থেকে পাওয়া এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার লভ্যাংশ অবণ্টিত রয়েছে। এই অর্থ পুরোটা এ তহবিলে নিতে চায় বিএসইসি। কিন্তু ব্যাংক কোম্পানি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তাতে আপত্তি তুলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য কোনো ব্যাংক এ তহবিলে এখনও অদাবিকৃত লভ্যাংশের অর্থ জমা দেয়নি।

সম্প্রতি পুঁজিবাজার স্টাবিলাইজেশন ফান্ড থেকে ১০০ কোটি টাকা আইসিবিকে দিতে চুক্তি করেছে তহবিল ব্যবস্থাপনা কমিটি। এই অর্থের পুরোটাই পুঁজিবাজারের উন্নয়নে ভ‚মিকা রাখবে বলে জানিয়েছে বিএসইসি।

এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তারল্য প্রবাহ বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান আইসিবি শত কোটি টাকার এ তহবিল দেয়া হচ্ছে। এটি আইসিবিকে দেয়া হচ্ছে ঋণ হিসেবে। যেহেতু বিনিয়োগকারীদের অর্থ; তাই সুরক্ষা নিশ্চিত ও ঝুঁকিমুক্ত করতে ঋণ হিসেবে দেয়া হয়েছে। এর দায় দায়িত্ব আইসিবির। এ অর্থ ফেরত দিতে হবে।’

অর্থ দেয়ার চুক্তি হওয়ার পরই রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান আইসিবি’র বিনিয়োগ সক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয় বিএসইসি। বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, ডিএস৩০ সূচকে তালিকাভুক্ত কোম্পানির মোট শেয়ারের সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত ক্রয় করতে পারত। এর বেশি ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এই নিষেধাজ্ঞা এখন তুলে দিয়েছে বিএসইসি। ফলে এখন থেকে আগের চেয়ে বেশি শেয়ার ক্রয় করতে পারবে আইসিবি।

বতর্মানে এই সূচকে ৩০টি কোম্পানি রয়েছে। যেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ৫০ কোটি টাকা এবং শেয়ার লেনদেনকৃত অর্থের পরিমাণ প্রতি তিন মাসের গড়ে দৈনিক ভিত্তিতে ৫০ লাখ টাকা করে হবে। এজন্য প্রতি তিন মাস অন্তর এ তালিকা পুনর্বিন্যাস করে থাকে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)।

বর্তমানে এ সূচকে উল্লেখযোগ্য তালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে রয়েছে বিএটিবিসি, বিবিএস কেব্লস, বীকন ফার্মা, বেক্সিমকো, ব্র্যাক ব্যাংক, বিএসসিসিএল, বিএসআরএম লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মা, সিটি ব্যাংক ও ফরচুন সুজ।

এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে ফরচুন সুজ। এক বছর আগে শেয়ারটির দর ছিল মাত্র ১৯ টাকা ৪০ পয়সা। কোনো কারণ ছাড়াই শেয়ারটির দর হু হু করে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে শেয়ারটির দর ১৪২ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমানে দরপতনের বাজারে এ শেয়ারটির দরও কমে যায়। সর্বশেষ শেয়ারটি ১১৯ টাকায় লেনদেন হচ্ছে। ডিএস৩০তে বিনিয়োগের ঘোষণার আগে শেয়ারটির দর ১০৩ টাকায় নেমে ছিল, যা পুনরায় ১১৯ টাকায় উঠেছে। শেয়ারটির এমন অস্বাভাবিক শেয়ারের দর নিয়ে বিনিয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডিএসই কয়েকবার তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়। প্রতিবারই ফরচুন সুজের পক্ষ থেকে বলা হয়, মূল্য সংবেদনশীল কোনো তথ্য নেই কোম্পানির কাছে।

অথচ তারপরও শেয়ারটির দরে খুব একটা প্রভাব পড়েনি। ২০২১ সালে বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ ও পাঁচ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ দিয়েছে কোম্পানিটি। এর আগের বছর ২০২০ সালে দিয়েছিল পাঁচ শতাংশ বোনাস ও পাঁচ শতাংশ নগদ। আর ২০১৯ সালে দিয়েছিল ২০০ শতাংশ নগদ ও ১৮ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ। কিন্তু ওই বছরটিতেও কোম্পানিটির শেয়ারের দর এত বৃদ্ধি পায়নি। অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া শেয়ারদরের এ কোম্পানিতে কারসাজি চক্রের উপস্থিতির বিষয়টি এখন বাজারে ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে।

আবার মৌলভিত্তির বীকন ফার্মার শেয়ারটি এক বছর আগে লেনদেন হয়েছে ১২৮ টাকায়। সেই শেয়ারটির এখন ২৬৭ টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। এ শেয়ারে বিনিয়োগ করে লভ্যাংশের পাশাপাশি শেয়ারের বাজার মূল্যে বিবেচনায়ও বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। একইভাবে বিবিএস কেব্লস, বেক্সিমকো, বিএসআরএম লিমিটেড, ডেল্টা লাইফ ও ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। মৌলভিত্তির এসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে এখনও কয়েকগুণ বেশি মুনাফায় রয়েছেন। যদিও এই সময়ে সূচকের পতন হয়েছে; বেশিরভাগ শেয়ারের দরপতন হয়েছে। বাজারের সব সূচকের পতনের চাপ সামলিয়ে লাভের মুখ দেখাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের এসব শেয়ার। এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে হতাশ হতে হয়নি বিনিয়োগকারীদের।

এদিকে তালিকায় থাকা অন্যান্য কোম্পানির শেয়ারের দরে খুব একটা লোকসান দেখা দেয়নি। ওষুধ খাতের স্কয়ার ফার্মার শেয়ারদর এক বছর আগে ছিল ১৯৫ টাকা। কভিড-১৯ মহামারি সংক্রমণের সর্বোচ্চ সময়ে ওষুধের চাহিদা বেশি থাকায় কোম্পানিটি সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করে। এতে মুনাফা যোগ হয়। এ কারণে কোম্পানিটির শেয়ারে আকৃষ্ট হন বিনিয়োগকারীরা। এক পর্যায়ে ব্যাংকটির শেয়ারের দর সর্বোচ্চ ২৫২ টাকায় ওঠে। এরপর ফের পতন হতে থাকলে বর্তমানে ১৬৯ টাকা ৯০ পয়সায় লেনদেন হচ্ছে। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, এর দরপতনের কারণ হচ্ছে বাজারের সার্বিক পতনের চাপ। সাময়িক সময়ের মধ্যে শেয়ারটির দর আরও ভালো অবস্থানে যাবে, যার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে।

আবার ওষুধ খাতের আরেকটি কোম্পানির শেয়ারদর নিয়ে বাজারে প্রশ্ন রয়েছে। এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আবু আহমেদ বলেন, ‘ফরচুনের মতো বিতর্কিত ও কারসাজির কোনো শেয়ার ডিএস৩০তে তালিকাভুক্ত রাখাই ঠিক না। এটি এখনই বের করে দেয়া উচিত। এখানে থাকবে সব মৌলভিত্তির কোম্পানি।’

আইসিবির ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানির সাধারণ শেয়ারে ২০২১ সালে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১২ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। তালিকভুক্ত ও তালিকাবহিভর্‚ত কোম্পানির শেয়ারের বিপরীতে আনরিয়েলাইজ লোকসান থাকায় আন্তর্জাতিক হিসাব মান অনুযায়ী, প্রভিশন রাখার প্রয়োজন ছিল এক হাজার ৭৬১ কোটি টাকা।

শেয়ারের ক্রয় মূল্য ছিল ১৩ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে বাজার মূল্য হচ্ছে ১২ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা। অতিরিক্ত মিলিয়ে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ রাখতে হতো এক হাজার ৭৯১ কোটি টাকা। কিন্তু আইসিবি রাখতে পেরেছে এক হাজার ৬৭ কোটি টাকা। প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৭২৪ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, আনরিয়েলাইজড লোকসান দেখা দিলেও নির্দিষ্ট হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এজন্য ব্যাংকগুলোকেও এই নিয়ম মানতে বাধ্য করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রভিশন ঘাটতি পূরণ না করে ডিভিডেন্ড দেয়ার বিষয়ে আইসিবি ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, ‘আনরিয়েলাইজড লোকসানের বিপরীতেও প্রভিশন ঘাটতি রাখতে আইসিবিকে বিশেষ ওয়েভার দিয়েছে বিএসইসি।’ কিন্তু কেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মানা হলো না এমন বিষয়ের কোনো উত্তর দেননি তিনি।

হিসাববিদরা বলছেন, কোনো শেয়ার বা বিনিয়োগের বিপরীতে প্রভিশন রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিনিয়োগকে ঝুঁকিমুক্ত রাখা। প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ সক্ষমতা ধরে রাখা। বিনিয়োগ বা শেয়ারটি লোকসানে চলে গিয়েছে; এটি আবার লাভজনক নাও হতে পারে। যদি লাভজনক হয়, তখন মুনাফায় যোগ হবে প্রাপ্ত অর্থ। নইলে আদায়ের ব্যবস্থা করতে হবে।

আইসিবির বিনিয়োগ এখনই ঝুঁকিতে চলে গেছে। এজন্য ডিভিডেন্ড না দিয়ে প্রভিশন সংরক্ষণ করা প্রয়োজন ছিল। কোম্পানিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে পরিচালকরা ডিভিডেন্ড নিতে পারেন না। এ বিষয়ে আবু আহমেদ বলেন, ‘আইসিবির শেয়ারের পোর্টফলিওতে জাঙ্ক শেয়ারের পরিমাণই বেশি।’

তথ্য বলছে, প্রভিশন শর্টফল রেখে আইসিবি ২০২১ সালে মুনাফা দেখিয়েছে ১১৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০২০ সালে ৫৬ কোটি ৪৯ লাখ ও ২০১৯ সালে দেখিয়েছে ৬০ কোটি টাকা। ২০২১ সালে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিয়েছে ১১ শতাংশ নগদ। অথচ ২০২০ সালেও আইসিবির প্রভিশন ঘাটতিতে ছিল।

Leave A Reply

Your email address will not be published.