আস্থার অভাবে শেয়ারবাজারে লেনদেনে সংকট

0

স্টকরিপোর্ট প্রতিবেদক : আস্থার অভাবে দেশের শেয়ার বাজার। এতে দেখা দিয়েছে লেনদেন সংকট। দেশের শেয়ারবাজার রীতিমতো ধুঁকছে। লেনদেন একেবারে তলানিতে। সূচক কমছে, শেয়ারের মূল্য কমছে।

তথ্যে দেখা যায় সর্বশেষ কর্মদিবস বৃহস্পতিবার দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) লেনদেন কমে ২৯৯ কোটি টাকায় নামে। গত ২৮ মার্চ লেনদেন নেমেছিল ২৭২ কোটি টাকায়। মাঝেমধ্যে লেনদেন ৪০০-৫০০ কোটি টাকা হচ্ছে, তবে সেটিকে কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা হচ্ছে বলে অভিমত বাজার বিশ্লেষকদের। এসব কারণে বাজারে চরম আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের শেয়ারবাজারে ধস নামার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকলেও প্রধান কারণ হচ্ছে ফ্লোর প্রাইস বা সর্বনিম্ন বাজারমূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া। গত বছরের ২৮ জুলাই এক নির্দেশনা দিয়ে প্রতিটি সিকিউরিটিজের ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেয় বিএসইসি। দুই দিন পর ৩১ জুলাই ফ্লোর প্রাইস কার্যকর হওয়ার পর থেকেই শেয়ারবাজারে লেনদেন খরা দেখা দেয়। দুই হাজার কোটি টাকার ওপরে উঠে যাওয়া লেনদেন ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে এখন দুইশ কোটি টাকার ঘরে এসে ঠেকেছে।

ফ্লোর প্রাইস ছাড়া শেয়ারবাজারে দেশি-বিদেশি বড় কোনো কোম্পানির নতুন বিনিয়োগ না আসা, ব্যাংকের সুদের হার বাড়ায় বিনিয়োগকারীদের এফডিআরের প্রতি ঝুঁকে পড়া, উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব, মুদ্রা বাজারের অস্থিরতা, সর্বোপরি নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে শেয়ারবাজারে।

শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এক বছর আগে যখন বিএসইসি বাজারে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়, তখনই বাজারের স্বাভাবিক গতিকে আটকে দেওয়া হয়। আমি তখন থেকে আজ অবধি ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণের বিরোধিতা করে আসছি। এটিই এখন শেয়ারবাজারে ধসের প্রধান কারণ। মার্কেট চলবে মার্কেটের গতিতে কিন্তু ফ্লোর প্রাইস বেঁধে দেওয়ায় মার্কেটের স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত করে শেয়ারবাজারের সর্বনাশ করা হচ্ছে। ফলে শেয়ারবাজারের ৭০ শতাংশ কোম্পানির কোনো লেনদেনই হয় না। গুটিকয়েক কোম্পানির শেয়ারবাজারের কিছু জুয়াড়ি সিন্ডিকেট করে এক রকম হাওয়া দিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছে। এভাবে তো একটি দেশের শেয়ারবাজার চলতে পারে না।

তিনি বলেন, এর আগে যখন নির্বাচনের বছর এসেছে, তখন দেখা গেছে দেশের শেয়ারবাজার চাঙ্গা হয়েছে। এ বছর তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে এবারের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। সামনে কী হয় না হয়-একটা ধোঁয়াশা ভাব। এ জন্য একদিকে যেমন বড় কোনো কোম্পানি নতুন বিনিয়োগ নিয়ে আসছে না, অন্যদিকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও বুঝে-শুনে পা ফেলছে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও শেয়ারবাজারের স্থবিরতার পেছনে আরও কিছু কারণ আছে। যেমন-দেশি-বিদেশি বড় কোম্পানির বিনিয়োগ না আসায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বাজারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে না। ব্যাংকে সুদের হার বাড়ানোরও প্রভাব রয়েছে বাজারে। সুদের হার বাড়ানোয় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অনেকেই শেয়ারবাজার ছেড়ে এফডিআরে বিনিয়োগ করছেন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছে, শেয়ারবাজারের প্রতি তাদের আগ্রহ কমে গেছে। মিউচ্যুয়াল ফান্ড লভ্যাংশ দিচ্ছে মাত্র ৩ থেকে ৪ শতাংশ। এত অল্প লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের বাজারবিমুখ করছে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে পিটিয়েও বিনিয়োগকারীদের বাজারে আনা যাচ্ছে না।

বাজার কি চাঙ্গা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই-এ প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজার চাঙ্গা করতে হলে একটি ভালো জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। আর ফ্লোর প্রাইস তুলে নিতে হবে। তা হলেই বাজার আবার চাঙ্গা হয়ে যাবে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ফিরে আসবে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাজারে এখন নানা রকম গুজবও ছড়ানো হচ্ছে। গত সোমবার শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার আগেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে হ্যাকাররা একাধিক ব্যাংক হ্যাকিংয়ের চেষ্টা করছে। একই সঙ্গে গুজব ছড়ায় প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ নিষেধাজ্ঞা দিতে যাচ্ছে। এ ছাড়া সামনে রিজার্ভ কমে যেতে পারে, এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ায় ওইদিন শেয়ারবাজারে বড় দরপতন হয়। আর বুধবার গুঞ্জন ছড়ায় ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ওয়েবসাইট হ্যাকিং হয়েছে। এমন গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ায় বুধবারও শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়। এতে দুই দিনেই ডিএসইর প্রধান সূচক ৬৬ পয়েন্ট পড়ে যায়।

এ পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজারে লেনদেন শুরু হওয়ার পরপরই মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ হাউস এবং বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক দুটি বৈঠক করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। এই বৈঠকের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে লেনদেন শুরুর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বেড়ে যায়। এতে লেনদেনের ১০ মিনিটের মাথায় ডিএসইর প্রধান সূচক বাড়ে ২২ পয়েন্ট। লেনদেনের শুরুতে দেখা দেওয়া এমন ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লেনদেনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ফলে দিনের লেনদেন শেষে ডিএসইতে সব খাত মিলে ১৫৩ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দাম বাড়ে। বিপরীতে দাম কমেছে ৮টির। আর ১৬০টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম বাড়ায় ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ৩৪ পয়েন্ট বেড়ে ৬ হাজার ২৫৪ পয়েন্টে অবস্থান করে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ আগের দিনের তুলনায় ৭ পয়েন্ট বেড়ে ১ হাজার ৩৫৮ পয়েন্টে দাঁড়ায়।

এদিন সবকটি মূল্যসূচক বাড়লেও ডিএসইতে লেনদেন আশঙ্কাজনক হারে কমে যায়। দিনভর বাজারটিতে লেনদেন হয়েছে ২৯৯ কোটি ৫২ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয় ৩৫১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। সে হিসাবে এক দিনের ব্যবধানে লেনদেন কমেছে ৫২ কোটি ১ লাখ টাকা। এর মাধ্যমে চলতি বছরের ২৮ মার্চের পর ডিএসইতে সর্বনিম্ন লেনদেন হলো। গত ২৮ মার্চ বাজারটিতে ২৭২ কোটি ৫ লাখ টাকার লেনদেন হয়।

এদিকে শেয়ারবাজারে পতন ঠেকাতে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে বড় বড় ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকের সহায়তা চায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সে জন্য এসব প্রতিষ্ঠান শেয়ার বিক্রি কমিয়ে দেয়। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অবশ্য কারসাজি হয় এমন কিছু শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় কারসাজিকারীরা। তাতে কোনো কোনো শেয়ারের সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। এভাবেই গত বৃহস্পতিবার বাজারে কৃত্রিমভাবে সূচক বাড়ানো হয়। এটিকেই বাজারের স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করার প্রক্রিয়া বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।

ধুঁকতে থাকা শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থা না থাকা, কাক্সিক্ষত লভ্যাংশ না পাওয়া এবং অনিশ্চয়তার মুখে বাজার ছেড়ে চলে যাচ্ছে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। বাজারের এ পরিস্থিতিতে গত দেড় মাসেই এক লাখের বেশি বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়া এই বিও হিসাবের মধ্যে যেমন স্থানীয় বিনিয়োগকারী রয়েছে, তেমনি বিদেশি বা প্রবাসী বিনিয়োগকারীরাও রয়েছেন। পাশাপাশি রয়েছে কোম্পানির বিও হিসাবও। তবে নারী বিনিয়োগকারীর তুলনায় বন্ধ হওয়া বিও হিসাবে পুরুষ বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশি। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি অব বাংলাদেশের (সিডিবিএল) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের মোট বিও হিসাব ছিল ১৮ লাখ ৬০ হাজার ৭৭৪টি। আগস্টের মাঝামাঝি এসে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪৫ হাজার ১৮৪টি। অর্থাৎ দেড় মাসের ব্যবধানে বিও হিসাব কমেছে ১ লাখ ১৫ হাজার ৫৯০টি।

তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, গত দেড় মাসে পুরুষ ও নারী উভয় ধরনের বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমেছে। বর্তমানে পুরুষ বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব আছে ১৩ লাখ ৬ হাজার ২১টি। জুন শেষে এই সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৯১ হাজার ৩৯৭টি। অর্থাৎ পুরুষ বিনিয়োগকারীদের হিসাব কমেছে ৮৫ হাজার ৩৭৬টি। অপরদিকে, বর্তমানে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব দাঁড়িছেছে ৪ লাখ ২২ হাজার ৭৬০টি। জুন শেষে এই সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৫২ হাজার ৫৩২টি। এ হিসাবে নারী বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব কমেছে ২৯ হাজার ৭৭২টি। এদিকে বর্তমানে কোম্পানি বিও হিসাব রয়েছে ১৬ হাজার ৪০৩টি। জুন শেষে এই সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৮৪৫টিতে। সে হিসেবে কোম্পানি বিও হিসাব কমেছে ৪৪২টি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.